বৃষ্টির গান ও স্মৃতির খাতা: সি আর পার্কে এক বর্ষার মনন
–– ড. অনিন্দিতা রায় | সি আর পার্ক, দিল্লি
আবার ফিরে এসেছে বর্ষা — সযত্নে, বিনম্রভাবে, যেন বহুদিন পর ফেরা এক পুরনো বন্ধু। দিল্লির আকাশ ঢেকে গেছে ধূসর মেঘে, ভারী, কিন্তু কোমল। চারপাশের গাছেরা — বিশেষ করে আমার প্রিয় সজনে গাছটা — যেন অপেক্ষা করছিল এই ঋতুর জন্য। বৃষ্টির ছোঁয়ায় সবুজটা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে — ঘাস, দেওয়াল, ছাদ আর রাস্তাগুলো যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
এই রকম মেঘলা দিনগুলোয় মনটা অদ্ভুতভাবে ধীর হয়ে আসে। গাছের ডালে চারটে কাঠবিড়ালি দৌড়চ্ছে — তাদের মনে যেন শুধু খেলা আর বৃষ্টির আনন্দ। একা একটি বুলবুল গুনগুন করে — তার ডাকের মধ্যে একটা অচেনা সুখ। শালিকেরা দল বেঁধে ঘোরে আর টিয়ার দল বিদ্যুৎগতিতে সবুজ ছটায় মেঘের ক্যানভাসে লাইন টানে। যেন বৃষ্টি এসে আমাদের সি আর পার্ককে আবার একবার বনে পরিণত করেছে — গাছ, পাখি, জল, শব্দ আর নিস্তব্ধতার এক অদ্ভুত সমাহার।
কিন্তু বর্ষা কেবল প্রকৃতিকে নয়, মনে এনে দেয় স্মৃতি।
অনেক সন্ধ্যায়, জানালার পাশে বসে থাকি আমি — বাইরে ভারী বৃষ্টি আর ঝাপসা আকাশ, ভিতরে বাজে রবীন্দ্রসঙ্গীত। বৃষ্টির গান — মন মোর মেঘের সঙ্গী, এসো শ্যামল সুন্দর, আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে — যেন এক এক করে মনটাকে আচ্ছন্ন করে। বৃষ্টির শব্দ বাইরে চলতেই থাকে, আর ভেতরে আমার মনের আকাশে জমে ওঠে স্মৃতির মেঘ।
তখন মনে পড়ে আমি আর দিল্লিতে নেই। আমি ফিরে গেছি হাজারিবাগে — আমার ছোটবেলার দিনগুলোতে। আমাদের বাড়ির সামনের বারান্দা থেকে দেখতাম — লাল মাটির পথ বৃষ্টিতে গলে গিয়ে ছোট নদী হয়ে যেত। দূরের ধানক্ষেতগুলো জলে টইটম্বুর, সেখানে ব্যাঙ ডাকছে একসঙ্গে, আর ধোঁয়াটে টিলাগুলো যেন বর্ষার চাদরে মোড়া বিশাল ঘুমন্ত প্রাণী।
তখন ছিল না মোবাইল, ছিল না অনবরত ব্যস্ততা — শুধু প্রকৃতির নিজস্ব সঙ্গীত। ভিজে মাটির গন্ধ, দূরের মেঘগর্জন আর রান্নাঘর থেকে আসা খিচুড়ি আর বেগুনির গন্ধ — সেই ছিল আমার প্রথম বর্ষার গান। কোনও রেকর্ডিং ছিল না, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত আজও গেঁথে আছে হৃদয়ে।
আজ, আমার সি আর পার্কের ঘরে, সজনে গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, যেন সেই পাহাড়গুলোর স্থলাভিষিক্ত। পাখিরা আবার গান গায়, বৃষ্টি আবার পড়ে, আর রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর যখন বাজে, তখন মনের মধ্যে একটা ছোটবেলার বৃষ্টি ফিরে আসে।
বর্ষা কেবল ঋতু নয়। বরং, বর্ষা হল অনুভব, স্মৃতিচারণ, আর এক নীরব ঘরে ফিরে আসা।

No comments: